![]() |
| চিন্ময়ী দাস শিক্ষিকা বর্ধমান |
কাব্যগ্রন্থ - স্বীকারোক্তি বাকি আছে
কবি - সন্দীপ কুমার মণ্ডল
প্রকাশক - বার্ণিক প্রকাশন
প্রকাশকাল - বর্ধমান লিটিল ম্যাগাজিন
মেলা ২০১৮
দৈনন্দিন জীবন অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির সংঘাতে
শব্দের সুনিপুন কৌশলে যে কাব্য কবি সন্দীপ কুমার মণ্ডল রচনা করেছেন তাঁর কেন্দ্র
থেকে পরিধি পর্যন্ত তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন নিঃসঙ্গতা, একাকীত্ব ও বিষণ্ণতার সুর। যদিও
এসব থেকে উত্তরণের দিশাও দেখিয়েছেন কবি। জীবনের নানা উত্থান- পতন, আশা- আশাভঙ্গের
সংকটময় পরিস্থিতিতে আমাদের মন সর্বদাই নির্জনতা পিয়াসি। আর সেই কারনেই কবি নদী কেই
সহমর্মী বলে মনে করেছেন। কবি তাই বন্যা
প্রেমিক। এই বন্যা নির্জনতার আর এক নাম। এই বন্যা আমার ভিতরের আর এক আমি।
আদ্যপান্ত
বিরহাছন্ন কবি নিজেকেই প্রশ্ন করেছেন- ‘আমি কি বিরহ বিলাসী ?’ কবির কলম রোমন্থন
করেছে প্রেমের আবছা স্মৃতি। গদ্য ছন্দে ভর
করে কবি পঙ্তির পর পঙ্তিতে সাজিয়ে দিয়েছেন স্বপ্ন, ভালোবাসা, যন্ত্রনা, আবেগ। পর
পর স্থিরচিত্র গুলি সাজিয়ে গড়ে তুলেছেন সমগ্র নির্মান। বন্যা, শীত আর মেঘের রূপক
রয়েছে একাধিক কবিতায়। প্রতিটি কবিতার মধ্যে রয়েছে এক ধরনের মন কেমন করা বিষাদ- ‘আমারও
কিছু চিরকুট ছিল, সে কথা থাক না হয়, যেভাবে বইয়ের ভাঁজে থেকে যায় পুরানো গোলাপ, যে
ভাবে আস্তিনের ভাঁজে অভিমান।’ স্বাভাবিক গদ্যের আশ্রয় সহজেই পাঠককে একাত্ম করেছে –
‘একটা ভুল মানুষ কে জীবন থেকে পিছিয়ে দেয় কয়েক ক্রোশ। আমি তো আদ্যপান্ত ভুলে ভরা
একটা মানুষ।” অথবা, “উড়তে দিলাম বলেই কি উড়তে দিতে পারি বন্ধনহীন। নিয়ম করে চোখ
রাখি তার উড়ানে।’
আমরা আমাদের
জীবনের দুঃখ কষ্টের ক্ষত গুলো ঢেকে রাখি রঙিন মোড়কে। বেঁচে থাকাটাই বড়ো কথা কি
ভাবে বাঁচছি বা কেন বেঁচে আছি সেটা নয়। জীবন বোধ থেকে উঠে আসা লাইন গুলি তাই সহজেই পাঠককে আকৃষ্ট করে।
যেমন- ‘কতদিন নিজিকে জড়িয়ে কাঁদিনি। কতদিন আয়নার সামনে না কামানো দাড়িতে হাত
বুলাতে বুলাতে নিজিকে জিঙ্গেস করিনি আমি ঠিক কি চাই।’ অথবা ‘স্মৃতি বড়ো
বহুরূপী। এক পশলা বৃষ্টি পেলে রঙ বদলে ভুলে যায় তিন মাস পুড়েছে উঠোন। নেশা মাঘে
সোঁদা গন্ধে, দুটো পলাশ দেখলে ভুলে যায় সদ্য পেরিয়ে এসেছে শীত।’ শীত ঋতুর রূপকে রচিত কবিতা গুলিতে জড়িয়ে আছে একাকীত্ব ও বিষন্নতা। শীতের অনুষঙ্গ দেখি বার
বার। এই শীত কোন ঋতু নয়, নিঃসঙ্গতা, একাকীত্ব ও বিষান্নতা রূপ যা সমগ্র বইটিতে
আচ্ছন্ন করে রেখেছে।
মৃত্যু
সম্পর্কে কবির ধারনাটাও বেশ অন্য রকম-
‘ মৃত্যু
যন্ত্রণা নাকি বাঁধন ছেঁড়ার উল্লাস
............................................................
প্রতিটি
মৃত্যুই আসলে এপিটাফের অজুহাত।’
আবার এই কবি
ভীষন ভাবে আশাবাদী। তাই –‘আমি শুধু একটা মোহনা প্রতীক্ষায় বসে থাকি। একদিন ঠিক পেরিয়ে
যাব এই রাত পোহানোর প্রহর।’
নির্লিপ্ততা
কবির অপর এক গুণ যা কবিকে আবেগ সংযমে সাহায্য করেছে। কবির হৃদয় মথিত উচ্চারণ –‘ফিরে
আসা আসলে হৃদয়ের কাঙালপনাকে পাবলিক করে দেয়। রাগ সঞ্চয় করা শিল্প যে শুধু সততাই
জানে।’ যা পাঠককেও সংযমী হবার শিক্ষা দেয়।
শৈলী ও অনুভূতির
গভীর সংমিশ্রণ তাঁর কবিতার প্রান। সহজসরলতা, মননশীলতার সঙ্গে কবির অনুভব কবিতা
গুলোকে আলাদা মাত্রা দিয়েছে। এক অনিবার্য বিরহকে মনে মনে লালন করেছেন কবি এবং তা ছড়িয়ে দিয়েছেন প্রতিটি কবিতায়। প্রতি
মুহুর্তের ব্যর্থতা থেকে তৈরী হওয়া ক্রোধ এড়িয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন কাব্যিক
ভাষায় – ‘বিষোদগারণ আসলে একটা ক্ষয়, নির্বিষতারদিকে এগিয়ে যাওয়া; বিষোদগারণ আসলে
একটা অহংকার।’ এক্ষেত্রে শীতঘুমকেই জড়িয়ে ধরতে বলেছেন প্রমাস্পদের মতো। তাঁর ভাবনা
পাঠককে আকৃষ্ট করে সহজেই। দৈনন্দিন নিরীক্ষণ, নস্টালজিয়া আর হৃদয়ানুভূতিকে তিনি
শব্দের মোড়কে সাজিয়েছেন। তবে শব্দ চয়নের ক্ষেত্রে তিনি সহজ বাংলা ভাষার সঙ্গে বিদেশী ভাষার সমাবেশ ঘটিয়েছেন। সব কবিতাই বিষণ্ণতার সুর। বেশীর ভাগ কবিতাই শেষ
হয়েছে ডট ডট ডট এ। অর্থাৎ কবিতার প্রবাহকে তিনি থামিয়ে দিতে চাননি। আর এভাবেই
কবিতার লাইন গুলি খুব সহজেই পাঠকের হৃদকথা হয়ে উঠেছে।

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন