সোমবার, ২০ জুলাই, ২০২০

স্বীকারোক্তি বাকি আছে আলোচক শ্রেয়সী কুণ্ডু সেনগুপ্তা

সন্দীপ কুমার মণ্ডল এর কাব্য সংকলন 'স্বীকারোক্তি বাকি আছে' বইটি নিয়ে পাঠপ্রতিক্রিয়া
পথের আলাপ পত্রিকার পক্ষ থেকে লিখেছেন শ্রেয়সী কুণ্ডু সেনগুপ্তা

'সব কথা বলা হয় না'- সত্যিই তো, কখনো নিজের মনের গভীরে ডুব দিলে হয়ত না বলা কথার একটা আস্ত গ্রেট ব্যারিয়ার রীফ আবিষ্কার করব আমরা। আমার মনে হয় 'কবিতা' হল শব্দের এমন এক বুনট যা দিয়ে পাঠক বা ও'পাশের মানুষটি নিজের মনপসন্দ যা কিছু বানিয়ে নিতে পারেন। তবে, একটি কবিতা হলে ঠিক ছিল, আমি নিয়ে বসলাম এক্কেবারে 'কাব্য সংকলন'! গত এক ঘন্টায় বেশ কয়েকবার পড়ে ফেলা কবিতাগুলোই আবার পড়ে ফেললাম, কিন্তু শব্দ কি আর এত সহজে কাছে এসে! মুশকিল, খুব মুশকিল! কিন্তু এই বইটির ব্যাপারে না বললে যে পাঠক হিসেবে অবিচার করা হয় শব্দের প্রতি। সময়ের মিছিলে অবহেলায় পড়ে থাকা স্বীকারোক্তি এবার ভেসে যাক নদীর স্রোতে, যার বৈতরণী সন্দীপ মন্ডল-এর কবিতা সংকলন 'স্বীকারোক্তি বাকি আছে'।
কবি সন্দীপ মন্ডলের এই বইটির সাথে আমার পরিচয় গতবছর জোড়াসাঁকো বইমেলায়। বার্ণিক প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত এই বইটির চমক শুরু হয় মলাট থেকেই। সেঁজুতি বন্দ্যোপাধ্যায় এর প্রচ্ছদ অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। বই খুললেই মলাটের হলুদ কাগজে একফালি ঝুপ করে সন্ধ্যে নামার মত ভাললাগা। 'আত্মোদঘাটনে দাঁড়িয়েও নিজের কাছে সব কনফেস করা হয় না। বাধ্য হয়েই যেতে হয় নদীর কাছে এবং অবধারিত বন্যার কাছে। সেখানেও কি সব স্বীকারোক্তি সেরে ফেলা যায়!' কত সাবলীল, সহজ সরল কিছু শব্দে কবি বিশ্লেষণ করেছেন এক সমুদ্র বোঝাই ভাবনা! এই সংক্ষিপ্ত ভূমিকা টি লক্ষ্য করলেই দেখা যায় কবি বাংলা ছাড়াও ব্যবহার করেছেন অন্যভাষার কিছু শব্দ। বইয়ের বেশ কটি কবিতাতেও এই বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়, দেখা যায় কিছু উর্দু, ফারসি শব্দ। এমন অবলীলায় অন্যভাষার শব্দের সাথে বাংলা ভাষার একই পঙক্তিতে ব্যবহার পাঠক মনে এক অমোঘ আকর্ষণ সৃষ্টি করে। পাঠক মনও অবলীলায় কেমন আউড়ে ফেলে, 'একদিন ঠিক পেরিয়ে যাব লাগাতার খোয়াইসের দুর্লঙ্ঘ্য দেহলিজ্'।

এই বইটিতে মোট ছাপ্পান্ন টি কবিতা আছে, যার সবকটিরই একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল, লেখাগুলিতে অন্তমিল নেই। ছন্দ আমাদের ভাবনায়, মানুষের জীবনে, শুধু ক'টা শব্দের অন্তমিল যে কবিতার নিজস্ব ভাবাবেগ, আর্তি বদলাতে পারে না সন্দীপ মন্ডলের সবক'টি কবিতায় তা ভীষণভাবে স্পষ্ট। কবির লেখায় শব্দের সাথে অদ্ভুত এক সেতু স্থাপন হয় পাঠকের, যা কবিতার থেকে সদাই কাম্য। 'অন্তঃসলিলা', 'আলফাজ', 'ইউথেনেশিয়া', 'মেঘস্তবক', 'ক্ষণজন্মা' কবিতাগুলি পাঠককে ভাবতে শেখায়, যতদূর ভাবলে কবিতা হয়ে ওঠে পাশের বাড়ির চঞ্চল মেয়েটির মত সাবলীল, অথবা ঘুমিয়ে থাকা শিশুর মত সরল, অথবা এমন একজন প্রেমিক যে অবলীলায় বলতে পারে, 'বন্যার জল নেমে গেছে। বাঁধ মেরামতির কাজ চলছে, মেন এট ওয়ার্ক। আমি বাঁধের উপর বসে বন্যা দেখব, ঢেউ আসবে, সময় বয়ে যাবে। বাঁধ থেকে যাবে তার মেরামতি নিয়ে আগামী বন্যার অপেক্ষায়। এই অপেক্ষাকেই আমি পথ বলি'।

প্রচ্ছদঃ সেঁজুতি বন্দ্যোপাধ্যায়

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন