অন্যদিনের মতোই কাজে বেরিয়েছি। ও মা! রাস্তায় এ তো দেখি জনসমুদ্র। আশেপাশের এগারোটা গ্রাম থেকে হলুদ হলুদ কয়েকদল নরনারী নদীর দিকে চলেছে। দূর থেকে গাঁদা ফুলের জমি যেমন দেখতে লাগে ওইরকম। শুধু হলুদ আর হলুদ।
রাস্তায় উঠতেই চমকে গেলাম। আমার কানের ভিতর তখন উড়োজাহাজের আওয়াজের মতো একটা গোঙানি গোঁ গোঁ করছে। নিজের বাইকের আওয়াজটাও শুনতে পাচ্ছি না। সামনে নাটকের ড্রপসিনের মতো কি একটা এগিয়ে চলেছে শামুকের গতিতে। তাকে দিওয়ালির টুনি বাল্বের মতো করে চারিদিক সাজিয়ে দিয়েছে সাদা সাদা ঝিনুকের মালা। একটু কাছে আসতে বুজলাম ওটা ড্রপসিন নয়, দুম্বো দুম্বো বেশ কিছু বক্স যাকে ছবিতে মালা পড়ানোর মতো করে মাইকের চোঙ দিয়ে মালা পরানো হয়েছে। একটা ট্রাক্টর পুরো মাইক চোঙ আর বক্সে ঢাকা পরে গেছে আর গোঙানিটা কারখানার ধোঁয়ার মতো হুরহুর করে ওইখান থেকে বেরোচ্ছে।
![]() |
তার সামনেই নৃত্যরতা একদল ভোলানাথের চ্যালা-চ্যালি। কি যে একধরণের অদ্ভুত শব্দ বেরোয় আজকাল মাইকের ভিতর থেকে, মনে হয় বুকের ভিতরটা কে যেন শিল-নোড়ায় বাঁটছে। আহা, দু’হাত তুলে সে কি নেত্ত। বাবা যদি সামনাসামনি দেখতেন নিঘঘাত বাঘছাল খুলে যেত। দেবদাস সিনেমার ‘মার ডালা, মার ডালা’ গানে এমন নাচ হতে পারে জানলে দেবদাসের ডিরেক্টর সাহেব মাধুরী দীক্ষিত নয় ইশা কোপিকরকে দিয়ে চন্দ্রমুখী করাতেন। মুখ ফসকে নামটা বলে ফেলতেই নেত্তরতা মহিলা বললেন, “কিসের উপকার? উঁ?” ওনাকে ইশা কোপিকর বলেছি বলে পাশের নেত্তারতা এমন তাকালেন যেন স্বামীর পরস্ত্রীর উপর নজর পরেছে। আমি কাঁচুমাচু করে বললাম, ইয়ে মানে আপনিও মালাইকা অরোরা। “হতচ্ছাড়া, এই দামোদরে মাল কাঁকড়া কোথায় পাবো র্যা ?” আমি আর কথা বাড়ালুম না। এতক্ষণ খেয়ালই করি নি, সানি লিওনিও ছিলেন, তার দিকে তাকাতেই বোধহয় মনের কথা বুঝে নিজেই বললেন “সোয়ামি নেল নি, তাই তো যাচ্ছি বাবার মাথায় জল ঢালতে”
ওফ ফো... এতক্ষণে মস্তিক জাগ্রত হল, কেন এত কোলাহল তবুও সিওর হবার জন্য এক হলুদ বাবুমশায়কে জিজ্ঞেস করলুম, আজ এত ভিড় কেন? যেন সংক্ষেপে নোটবদলের ফলাফল জানতে চেয়েছি এমন মুখ করে বললেন, “আজ ছাবনের ছেচ ছোমবার” উরিশ্লা! ছ’য়ের এমন অনুপ্রাস জম্মে শুনিনি।
যাই হোক আর কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস হলনা। তবে বুঝতে পারলাম সবকটা দলেরই একজন করে সর্দার আছে, মানে উদ্যোক্তা আর কি! আমাদের গ্রামের দেড়ফুটিয়া শিবলিঙ্গকে জলে চোবানোর দায়িত্ব নিয়েছে বাপি। দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলুম, হ্যাঁ রে, উত্তরবঙ্গ ভেসে দক্ষিণবঙ্গে চলে এল, তার মাঝে তোরা আবার এসবের আয়োজন করেছিস! এবার দক্ষিণবঙ্গ ভেসে কোথায় যায় বল দেখি! ভারি তো একটা দেড়ফুটিয়া শিবলিঙ্গ, তার পনের ফুটের মন্দিরে যত না আকন্দ থাকে তার থেকে বেশি থাকে ছাগলের ইয়ে। তবু যদি নবাবহাটের এক'শ আট মন্দির বা বর্ধমানের বুড়ো শিব হতো কতই না কি করতিস!
না মানে কথা গুলো গলার কাছে আটকে গেছে। বেরোয় নি। সামনে এত ভিড় পালাবার রাস্তা পেতাম না। সকালে অফিস যাওয়া প্রাণটা বেঘোরে শিবের বাঁকের চাবকানিতে চলে যেত। সামনে যে দলটা রয়েছে তারও একজন সর্দার আছে। মানে তাকেই আমার সর্দার মনে হয়েছিল আর কি, কেন হয়েছিল জানি না। বললুম, কাকা, একটু যাবার মতো রাস্তা করে দাও। আমার দিকে এমন করে তাকালো যেন আমি দাউদ ইব্রাহিমকে ধরে দিতে বলেছি। বুঝলাম এনাকে বলে কাজ হবে না। দল থেকে একটু পিছিয়ে পরা একজন নিজেকে টাইগার শ্রফ ভেবে জামার বুক খুলে হাঁটছেন। কাছে গিয়ে দেখলাম পাটকাটির উপর কে যেন হলুদ মাখিয়ে দিয়েছে। তবুও সাহস করে বললাম, কাকা একটু রাস্তা...... ঘোর লাগা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে একটা কেস্ট মুখুজ্জে স্টাইলের হাসি দিয়ে বলল, হঘিয়ে রাআআআস্তা! এক্ষুণি করে দিচ্ছি। বলেই আমার ডানপাশে দাঁড়িয়ে কোমর বেঁকিয়ে একটু সামনের দিকে ঝুঁকে অদ্ভুত এক স্টাইলে ডান হাতটা সামনে বাড়িয়ে একবার বাঁদিক ঝেঁটিয়ে দিল, আবার হাত উল্টো করে ডানদিক ঝেঁটিয়ে দিল। আমার মনে হল যেন হালুইকর তার কাঠের তাড়ু দিয়ে মিষ্টির ভিয়েন মারছে। “যাও বাবু, রাস্তা সাফ – চলে যাও”। রাস্তা সাফের কিছুই বুঝলাম না। যেটা বুঝলাম, ইয়ে অ্যায়সা ব্যায়সা দম নেহি... ইয়ে গাঁজা কা দম হ্যায়... এনারা সাদা ধোঁয়াতেও নীলকণ্ঠ ভোলানাথ দেখতে পান... আমি তো সামান্য রাস্তা দেখতে চেয়েছি।


Sundor ❤️❤️
উত্তরমুছুন