শনিবার, ২২ আগস্ট, ২০২০

স্বীকারোক্তি বাকি আছে আলোচক শ্রাবণী খাটুয়া (কৃষ্ণকলি)

শ্রাবণী খাটুয়া (কৃষ্ণকলি)
শিক্ষিকা
সারেঙ্গা, বাঁকুড়া 

 স্বপ্ন ও বাস্তবতার মাঝখানে কঠিন জমি

"বুকের ভিতর কিছু একটা ডানা ঝাপটায়, অথচ আমরা কেউই পাখি হতে পারছি না।"

“আমাকে ওই যজ্ঞ ডুমুরের মতো হতে হবে । অনুভূতিহীন, আত্মমগ্ন, ধ্যানস্থ ।"

নাহ্, কথাগুলো আমার নয় অথচ ভীষনভাবেই আমার । আসলে কথাগুলো কবি সন্দীপ কুমার মণ্ডল তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ  “স্বীকারোক্তি বাকি আছে" তে বলেছেন ।

আমাদের বুকের মধ্যে লুকিয়ে রাখা কিছু অনুচ্চারিত শব্দরাশি, যা কখনো বলা হয়নাবলা যায়না, সেসব কথাই যেন গোপন স্বীকারোক্তির মতো প্রকাশ পেয়েছে কবির লেখায়। চেনা পদ্য ছন্দের বাইরে গিয়ে গদ্য ও কবিতার মাঝামাঝি  এক স্বতন্ত্র লিখনশৈলীতে কবি তার অন্তরের আবেগ ফুটিয়ে তুলেছেন।  যে আবেগ পাঠক হৃদয়কে ছুঁয়ে যায় খুব সহজেই।  তার এক একটি লেখা যেন অভিমানী প্রেমিক মনের লুকিয়ে লেখা গোপন ডায়রির পাতা।  কবির কথায়, "নিঃসঙ্গতা আসলে কিছু স্মৃতি, কিছুটা সময়, কিছুটা দূরত্ব।”যে দূরত্বে চেপে কবির সাথে আমরা পাঠকও পৌঁছে যাই  “নশ্বর ফেরিঘাটে।  যেখানে ঢেউয়ে ঢেউয়ে চকচক করছে ফেলে আসা সময়, সময়ের গা জুড়ে আবিল স্মৃতির ঘ্রাণ, যে ঘ্রাণে কোনো নৌকা বুক পাতেনি উজান টানে।”

কখনো বা শব্দ সেতুর পথ বেয়ে পৌঁছে যাই স্বপ্ন ও বাস্তবতার মাঝখানে সেই কঠিন জমিটাতে যেখানে দাঁড়িয়ে জীবনের ঘাত প্রতিঘাত চড়াই উৎরাইয়ের কথা লিখতে গিয়ে কবি বলেছেন - "কেন  লিখতে এসেছিলাম ! কবিতা, গদ্যের আলাদা কোনো সংজ্ঞা আমি মানিনা। ......... তবে কেন লিখছি! এই সময়টা ডাটা এন্ট্রি করলে দু - পয়সা অতিরিক্ত আয় হত। ব্যস্ততায় ডুবিয়ে ফেলি নিজেকে।” অথবা “নায়ক অথবা খলনায়ক, শেষ দৃশ্যে মৃত্যু অনিবার্য। শুধু মৃত্যু দাগ বুকে নিয়ে গঙ্গাটা পেরিয়ে আসাটাই চ্যালেঞ্জ”।

"প্রতিটি ভেঙে পড়াই আসলে একেকটা বেঁচে থাকার প্রতিফলন, প্রতিটি মৃত্যুই আসলে একেকটা এফিটফের অজুহাত । ........ আসলে আমি মরতে ভয় পাই বলেই বেঁচে নেই ।"

 আমি এক সামান্য পাঠক। কবিতার চুলচেরা বিশ্লষণ করা আমার সাধ্যের বাইরে, কীভাবে পাঠ প্রতিক্রিয়া দিতে হয় তাও জানিনা তবে আমি চেষ্টা করি কবিতার মধ্যে কবির অনুভূতিটুকু ছুঁয়ে দেখার আর নিজের ভালোলাগাটা সকলের সাথে ভাগ করে নিতে কার না ভালোলাগে বলুন! এখানে আমি শুধু আমার ভালোলাগাটা সকলের সাথে ভাগ করে নিলাম । তবে আমার মনেহয় সৃষ্টি যখন স্রষ্টার পাঁজরের সীমা অতিক্রম করে পাঠকের মনের কথা হয়ে ওঠে তার হৃদয় ছুঁয়ে যেতে সক্ষম হয় সেখানেই সৃষ্টির আসল সার্থকতা।  কবি সন্দীপ কুমার মণ্ডলের সৃষ্টি সেদিক থেকে সার্থক এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় ।

আপনারা বইটি পড়ে দেখতে পারেন, আশাকরি খারাপ লাগবে না ।

সবশেষে কবি বন্ধুর জন্য রইলো আমার আন্তরিক শুভকামনা ও এক আকাশ ভালোবাসা।  তুমি আরো লিখতে থাকো বন্ধু ... আপনমনে সকলের মনের কথা

 কিছু ভালোলাগা লাইন *

"মেট্রোতে ঝাঁপ দেওয়া কি আর বড় কথা, শুধু মৃত্যু সংবাদটা তোমার কাছে পৌঁছে যাবে ... তাই...”(বিপ্লব)

"যে কথাটা লেবু ফুলের বাসের মতো বুকে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি অথচ বলতে পারছি না, ভালো থাকাটা হৃদয়ের কাছে একটা বিশেষ সংবাদ মাত্র।"(হাইবারনেশন)

"আসলে আমরা কেউ কাউকে ভুলিনা -- শুধু মনে রাখার ধরনটা বদলে যায় ..."(বড়দিন)

"নগ্ন নির্জন নিজস্বতায় স্বেচ্ছাচারী জ্যোৎস্নার তীর ধরে হেঁটে গেছি শুধু আর ভীষ্মের মতো অপেক্ষা করেছি একটা উওরায়ণের।”(ইউথেনেসিয়া)

"প্রতিটি নীরবতা আসলে যন্ত্রনার অভিজ্ঞতায় গড়া। প্রতিটি যন্ত্রণা ছায়া ছায়া গাছেদের মাথায় ইস্পাত রঙে জমতে থাকলে আমার এসরাজে মল্লার বেজে ওঠে।"(বিশল্যকরণী)

"যেকোনো ডিপ্রেশনের দেশে বৃষ্টিরা মহানুভব হয়।"(জল - ডুব)

"ঘুলঘুলি বেয়ে পয়গম্বর নেমে এলে পেরিস্কোপ ছাড়াই দৃশ্যমান ঢেউ ডিঙানো মাস্তুল।  অথচ ধারালো ব্লেডের আঁচড়গুলো তোমার হাতে ঢেউয়ের দাগ হয়ে ফুটে আছে "(সমুদ্রস্নান)


কবি সন্দীপ কুমার মণ্ডল

প্রকাশক বার্ণিক প্রকাশন, বর্ধমান

প্রচ্ছদ সেঁজুতি বন্দোপাধ্যায়

মুদ্রিত মূল্য - ১২০ টাকা (ভারতীয়) 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন