“বাড়ির ভিতর নারকেল গাছ
সামলে থাকিস ডাক্তারগিন্নি লো
তোর বরের যে মাথায় টাক”
সে গানের অদ্ভুত নেশা লাগানো সুর, শুনলে শুনতেই ইচ্ছে করে। আর সেই গানের লিরিকে হেসে খুন হতে হয়। ওরা বলে টুসু পরব। টুসু গানের আসল সুর কী, সে জানি না, কিন্তু জন্মাবধি এই বিশেষদিনে এই একসুরে গান শুনে এসেছি। খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, বছর পাঁচেক আগেও দেখেছি।
বাবুদের বাড়ির মনুকাকা শুধুমাত্র এই মজাটা পুরোমাত্রায় নেবার জন্যই পাড়ার সাঁকোতে বসে থাকত। তার কাজই ছিল, যারা গাইছে তাদেরকে উসকে দেওয়া, কারন এ তো সবাই জানি, উসকে দিলেই আগুন বেড়ে যায়। বুলিমাসিকে যেরকম সম্পর্কে আমি মাসি ডাকি, মনুকাকাও বৌদি ডাকে, সে সম্পর্কের ইতিবৃত্ত আমি জানি না। তবে রেগে গেলে যে কে কার মাসি বা বৌদি সে হিসেব কে কবে করেছে! রাগিয়ে দেবার জন্যই মনুকাকা তার বাঁহাতটা কোমরে রেখে, সামনে অল্প ঝুঁকে ডান হাতটা সামনে বাড়িয়ে বুলিমাসির কোমরের থলিটাকে ইঙ্গিত করে গেয়ে উঠল।
“তোর থলিতে কি আছে
বাবলা গাছে উই ধরেছে লো
রস ধরেছে খেজুর গাছে”
খেজুর গাছ বলার সময় পাশের মেয়েটির দিকে হাত দেখাল মনুকাকা। ব্যস, আর যায় কোথায়! বুলিমাসিকে বাবলাগাছ বলা!
জবাবও রেডি,
“অঘান মাস কি ভুলে গেলি
এই বাবলা গাছের ডাল ধরে লো
কাঁটা বিঁদে ঘর গেলি”
কাল সারারাত পাড়ায় পাড়ায় চলেছে কাঁচা মদ আর মাংসের সাথে বোল কাটাকাটি। পুব দিকের বাগদিপাড়ার সাথে দক্ষিনের মাজিপাড়ার লড়াই। কখন কোন গানের ছুতনো খুঁজে নিয়ে বাউরিপাড়াও এন্ট্রি নিয়ে নিয়েছে সে লড়াইয়ে। ছোটখাটো পেছনেলাগা যেটাকে আজকের দিনে লেগপুলিং বলে সম্ভবত সেসব থেকে একেবারে ব্যক্তিগত কেচ্ছাও ভেসে আসত সুরে সুরে। সেই আক্রমনে বাদ যেত না কেউ। বাবুদের বাড়ি কোন ছেলে কাজের নামে ঘরে ডেকেছিল কোন ছেমড়িকে, নয়তো দোলের দিনে রায়বাড়ির মোরে ছেলেটা রঙ মাখাবার বাহানায় কোন মেয়ের বুকে হাত দিয়েছে। কোন বাড়িতে কাজে গেলে মাইনে কম দেয়, কোন মুদির দোকানে জিনিসের দাম বেশি নেয় সে সবই যেন সারা গ্রামের জানা হয়ে যেত এক রাতেই।
আসলে প্রতিদিনের যাপনটাই উঠে আসত। যে জীবনটা তারা সারা বছর ধরে যাপন করে, তারই যেন বহিপ্রকাশ ঘটে এই মকরপরবে। হয়তো পুষে রাখা যন্ত্রণাও। সেই মুহূর্তে মুখের সামনে প্রতিবাদ করতে না পারার রাগটাও যেন এখন বেরিয়ে আসে।
আজ রাস্তায় শুধু ছই সাজানো গরুর গাড়ি, গরু দুটোর গলায় গাঁদার মালা, সাথে ঘণ্টা বাঁধা টুংটুং বাজছে। আজ পুরো রাস্তা তাদেরই। “রাস্তা কারও একার নয়” বললে আজ আড়ংধোলাইও জুটতে পারে। তাই ব্যক্তিগত যানবাহন ছাড়া আজ বাস সহ সমস্ত যানবাহন বন্ধ। শেষ কয়েক বছর আবার গরুর গাড়ির জায়গাটা দখল করে নিয়েছে ট্রাক্টর।
নিশিজাগরনের পর আজ সকালে মকরস্নান। বয়স্ক কিছু মহিলা অবশ্য ভোর ভোর সে স্নান সেরে এসেছে। কিন্তু সে সংখ্যা খুবই নগন্য। দলবেঁধে দামোদরে স্নান। আর তাদের যাত্রাপথের সঙ্গী এই টুসুগান। দুপাশে যা দেখে, যা ঘটে তাই বসে যায় তাদের সুরে সুরে। কখনও গানে ইঙ্গিতে সস্তা চটুলতাও ধরা পরে। ছই লাগানো গরুর গাড়িতে পিছন দিকে মুখ করে বসা একদল মেয়ে হঠাৎ গেয়ে উঠল
“সাইকেল চালাবি সাবধানে
এদিক ওদিক তাকাস যদি লো
ধাক্কা লাগবে পাষাণে”
সাথে সাথে পিছনে সাইকেল ঠেলে নিয়ে যাওয়া ছেলের দল থেকে উত্তরও এল
“তোর পেয়ারার জাত ভাল
এমন বাগানে না তাকাই যদি লো
বাগান মালির মুখ কালো”
পেরিয়ে যাচ্ছি এইসব অনাবিল আনন্দের দিনগুলো। আমি নিজেও ‘রাত জাগরনের’ রাতে অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে, রাস্তায় বাইক রেখে, সাঁওতাল ছেলেমেয়েগুলোর সাথে মাদলের তালে তালে পা মিলিয়ে নেচে খেজুর গুড় দিয়ে পিঠে খেয়ে বাড়ি ফিরেছি রাত করে। তারাও নিবিড় আনন্দে কাছে টেনে নিয়েছে।
পৌষ সংক্রান্তিতে অনেক গ্রামেই মেলা বসে। আমার গ্রামেও বসত পঞ্চগ্রামী মেলা। সে যেন ছ-সাতদিন ধরে পাঁচখানা গ্রাম জুড়ে হৈ হৈ। সারাক্ষন কানের কাছে পেঁ পোঁ বেজেই চলেছে। যাত্রা, সিনেমা, লেটো, আলকাপ, নাগরদোলা, সার্কাসে যেন দম ফেলার সময় ছিল না। সময়ের সাথে সাথে সেসব জৌলুষ কমতে কমতে যেন কবে তার প্রাণবায়ু বেরবে সেই অপেক্ষাই করছিল, আর সেখানেই চিতা সাজিয়ে দিল করোনা। গরুর গাড়ি, মাইক-বক্স বাঁধা ট্রাক্টরের হুল্লোড় নেই, কিন্তু আজও আমাদের গ্রামে এইদিনটাতে বাস চলে না। “রাস্তা কারও একার নয়”… রাস্তা আজ সবারই…
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন